পিতা-মাতার সন্তানের প্রতি কর্তব্য
প্রত্যেক
পিতা-মাতার জন্য সন্তান হলো আল্লাহর দেয়া একটি আমানত। সুতরাং, এই আমানতের রক্ষণাবেক্ষণ
করাটাও পিতা-মাতার অবশ্য কর্তব্যের মধ্যে পরে। আমাদের দেশে সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার
কর্তব্য নিয়ে তেমন একটা আলোচনা হয় না। তবে বর্তমান ফিতনার জমানায় এই বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে
বেশি আলোচনা হওয়া উচিৎ বলেই মনে করি।
সন্তানের
যেমন পিতা-মাতার প্রতি কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য আছে, পিতা-মাতারও সন্তানের প্রতি দায়িত্ব
ও কর্তব্য আছে। চলুন আজ এই বিষয়ে আলোচনা করা যাক:
১।
সন্তান জন্মের পর তার ইসলামি নাম রাখা:
সন্তান
জন্মের পর বাবা-মায়ের উপর প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হলো তাদের সন্তানের একটি সুন্দর অর্থবোধক
ইসলামি নাম রাখা। কারণ ব্যাক্তির উপর তার নামের প্রভাব রয়েছে। আরবীতে অনেক সুন্দর সুন্দর
অর্থবোধক নাম রয়েছে শিশুদের, বাবা-মায়েরা সেসব নাম রাখতে পারেন। অথবা বিভিন্ন নবী-রাসুল,
সাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে-সালেহীনদের নামে নাম রাখতে পারেন।
২।
জন্মের পর সন্তানকে একটি ইসলামি পরিবেশে বড় করে তোলা:
জন্মের
পর একটি শিশু তার বাবা-মা, পরিবারের অন্য সদস্য ও পরিবারের পরিবেশ থেকে অনেক কিছু শিখে
থাকে। বাবা-মা হলো শিশুর জীবনের প্রথম শিক্ষক আর পরিবার হলো শিশুর প্রথম বিদ্যালয়।
তাই বাবা-মা যদি প্র্যাক্টিসিং মুসলিম হন, তবে বাবা-মায়ের দৈনন্দিন জীবনে পালন করা
ইসলামি আচার-আচরণ দ্বারা শিশু প্রভাবিত হবে। পাশাপাশি পরিবারের পরিবেশটা যদি হয় ইসলামিক,
তবে একটা ইসলামি সংস্কৃতির মধ্যে শিশু বেড়ে উঠবে। শিশুরা অনুকরণ প্রিয়। তারা দেখে শিখে।
তাই একটা শিশুর জন্য ভবিষ্যতে আদর্শ মুসলিম হতে হলে বাবা-মা ও পরিবারের পরিবেশকে ইসলামিক
হতে হবে।
৩।
ইসলামি সংস্কৃতির মধ্যে শিশুকে বড় করা:
শিশু
যদি ছেলে হয়, তবে একটু বড় হবার পর থেকেই তাকে পায়জামা-পাঞ্জাবী ও টুপিতে অভ্যস্ত করা।
তাকে বড়-ছোট নির্বিশেষে সবাইকে সালাম দেয়ার শিক্ষা দেয়া। বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ
করার আদেশ দেয়া।
আর
শিশু যদি মেয়ে হয়, তবে তাকে ছোট বেলা থেকেই পর্দায় অভ্যস্ত করা। মাহরাম ও নন-মাহরাম
এর পার্থক্য বুঝানো – ইত্যাদি নানা পদ্ধতিতে তাকে ভবিষ্যতের জন্য একজন
আদর্শ মুসলিমাহ হিসেবে গড়ে ওঠার ট্রেনিং দেয়া।
৪।
ছোটবেলা থেকেই আইডল সেট করে দেয়া:
ছোটোবেলা
থেকেই শিশুদের নানা ইসলামী গল্প বলা। যেমনঃ নবী-রাসুলগণের জীবনী সহজবোধ্য ভাবে তাদের
গল্প আকারে বলা। সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন, তাবে-তাবেঈন, সালাফে সালেহীন সহ ইসলামের নানা
বীরদের জীবনী ও দ্বীনের জন্য তাদের ত্যাগ ও কোরবানীর কথা বলা। যেনো শিশুরা তাদেরকে
অনুকরণীয় আদর্শ মেনে নিজেদের সেভাবে কল্পনা করে এগিয়ে যায়।
৫।
প্রথম স্কুল হোক মাদ্রাসা:
শিশুরা
যখন একটু বড় হবে, অর্থাৎ পড়াশোনা শুরু করার বয়েসে পৌছাবে, তখন তাদেরকে মাদ্রাসায় দেয়া।
মাদ্রাসাই হোক আমাদের সন্তানদের প্রথম শিক্ষালয়, দ্বীনই হোক আমাদের সন্তানদের প্রথম
শিক্ষা। মাদ্রাসায় আমাদের শিশুরা দ্বীনি ও দুনিয়াবী উভয় ধরণের জ্ঞান অর্জন করতে পারবে।
মনে রাখবেন, শিশুর অন্তর হলো কাঁচা মাটির মতো, সেখানে আপনি যদি দ্বীনের ছবি আঁকেন তবে
সেটাকে আকড়ে ধরেই সে তার পুরো জীবন চলতে পারবে।
৬।
সহশিক্ষা থেকে দূরে রাখুন:
আমার
অনুরোধ থাকবে সবাই যেনো সন্তানদের মাদ্রাসায় পড়ান। তবে সেটা হয়তো নানা কারণে অনেক বাবা-মায়ের
পক্ষেই সম্ভব হবে না। যদি তা সম্ভব না ই হয়, তবে অন্তত প্রাথমিক শিক্ষাটা সন্তানকে
মাদ্রাসা থেকে নিতে দিন। এরপর যদি সন্তানকে নর্মাল স্কুলে দিতে চান, তাহলে এমন স্কুলে
দিন যেখানে সহশিক্ষা নেই। এমন অনেক স্কুল আছে, যেখানে সহশিক্ষা নেই। পাশাপাশি পড়াশোনার
পাশাপাশি ইসলামি আদব-আখলাকের প্রতিও নজর রাখে। এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সন্তানদের দিন।
পাশাপাশি নিজেও সন্তানদের দ্বীনের কি হালত সেই বিষয়ে খেয়াল রাখুন। প্রয়োজনে ব্যাক্তি
উদ্যোগে সন্তানদের আলেম-ওলামাদের সোহবতে থাকার ব্যাবস্থা করে দিন। এতে করে তারা কখনো
পথভ্রষ্ঠ হবে না, ইনশাল্লাহ।
৭।
বালেগ হবার সাথে সাথে সন্তানের বিয়ে দিন:
এই
লেখাটা পড়ে অনেকেই চমকে উঠবেন। অনেকে এটাও বলে উঠবেন যে, বর্তমানে এটা কি সম্ভব? আমি
বলবো, হ্যা, অবশ্যই সম্ভব। আপনি চাইলেই সম্ভব।
একটি
শিশু যখন শিশু থেকে বয়ঃসন্ধিকালে পৌছায়, তখন তার মনে বসন্তের বাতাসের মতো আবেগ আসে।
এই সময়টায় নানা কৌতুহল জাগে তার মাঝে। পাশাপাশি এই সময়ে সে একাকীত্বে ভোগে। মনে হয়,
আমার জীবনে ‘কেউ একজন’ আসুক। যে শুধু আমার হবে। যার হাত ধরে আমি পারি দেবো
সাত সমুদ্র তেরো নদী। যার হাত ধরে বৃষ্টিতে ভিজবো। জোছনা মাখবো গায়ে। এই সময়ে সেই ‘কেউ একজন’ এর প্রয়োজন অনেক বেশি থাকে। যদিও আমাদের বাবা-মায়েরা
তা বুঝেন না, অনেকে বুঝেও না বুঝার ভান করে থাকেন। সন্তানকে এমন এক সময়ে বিয়ে দেন,
যখন তার আর বিয়ের কোনো প্রয়োজনীয়তাই থাকে না। এই কারণেই সমাজে জেনা-ব্যাভিচার সহজ হয়েছে,
আর কঠিন হয়েছে বিয়ে। দয়া করে সমাজকে চুরান্ত ধ্বংস থেকে বাঁচাতে বিয়েকে সহজ করুন, দেখবেন
সমাজ থেকে জেনা-ব্যাভিচার তো দূর হবেই, পাশাপাশি অধিকাংশ সামাজিক সমস্যার সমাধান হয়ে
যাবে।
৮।
সন্তানকে ইলমের প্রতি উৎসাহী করুন:
আপনার
সন্তানকে দ্বীনি ও দুনিয়াবী বহুমূখী মাল্টি-ডাইমেনশনাল জ্ঞান চর্চায় উৎসাহী করে তুলুন।
মুসলিমরা একদা জ্ঞান বিজ্ঞানে মধ্যযুগে পৃথিবীতে কিভাবে নেতৃত্ব দিয়েছে সেই গল্প শোনান।
একেকজন মুসলিম মনীষী একাধারে জ্ঞানের একাধিক ক্ষেত্রে কিভাবে বিচরণ করেছেন তা শোনান।
এতে করে আপনার সন্তানেরা আব্বাসী যুগের মুসলিম মনীষীদের মতো বহুমাত্রিক জ্ঞান চর্চায়
আগ্রহী হবে।
৯।
সন্তানকে শাসন করুন ভালোবেসে, মারধোর করে না:
সন্তানকে
অবশ্যই শাসন করবেন। তবে আমাদের দেশের অনেক বাবা-মায়েরাই শাসন বলতে বুঝেন মারধোর করা।
কিন্তু না, শাসনের বিভিন্ন ধরণ রয়েছে। সবচেয়ে উত্তম শাসন হলো ভালোবেসে সন্তানকে কাছে
টেনে সুন্দর ভাবে কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ সেই বুঝ দেয়া।
সন্তানের
প্রতি পিতা-মাতার আরো অনেক কর্তব্য রয়েছে যা ধৈর্য্য ও হিকমার সাথে পালন করা উচিৎ প্রত্যেক
বাবা-মায়ের। দিন শেষে একটাই চাওয়া, আল্লাহ যেনো আমাদের চক্ষুশীতলকারী সন্তান দান করেন।
আমিন।