বাবা-মায়ের সাথে ভালো ব্যাবহার করুন
এই পৃথিবীতে আগমনের জন্য
আল্লাহ তা’আলা যে মাধ্যম আমাদের জন্য নির্ধারণ করেছেন তা হলো
বাবা-মা। আমরা প্রত্যেকেরই জন্ম হয় বাবা-মায়ের থেকে। জন্মের পর যে মানুষগুলোকে আমরা
দেখি, যাদের ভালোবাসার উষ্ণতায় থাকি তারা হলো বাবা-মা। এই দুনিয়ায় আল্লাহ রাব্বুল আলামিন
ও রাসুল (সাঃ) এরপর যে মানুষগুলো অকৃত্তিম ও নিঃস্বার্থ ভাবে আমাদের ভালোবাসেন তারা
হলের আমাদের পিতা-মাতা। তারাই আমাদের লালন পালন করে বড় করে তোলেন। প্রত্যেকটি প্রাণীই
তার ‘নিজস্বতা’ নিজে জন্মে। যেমন একটা কুকুর কুকুর হিসেবেই জন্মে,
একটা বিড়াল বিড়াল হিসেবেই জন্মে। তবে মানুষই একমাত্র প্রাণী যারা মানুষ হিসেবে শারীরিক
অবয়বে জন্মালেও তার মধ্যে মানবিক গুণাবলীর সংমিশ্রণ ঘটিয়ে তাকে আলাদা ভাবে মানুষ হতে
হয়। এই ‘মানুষ হবার
প্রকৃয়া’য় যারা আজীবন আমাদের সঙ্গ দেন তারা হলেন আমাদের পিতা-মাতা।
পিতা-মাতার যেমন আমাদের
প্রতি কিছু অবশ্য পালনীয় কর্তব্য আছে, তেমনি আমাদেরও আমাদের পিতা-মাতার প্রতি অবশ্য
পালনীয় কর্তব্য আছে। তবে বর্তমানে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবে আমাদের ও আমাদের বাবা-মায়ের
মধ্যে সম্পর্কের সমীকরণ বদলে গেছে। বর্তমান যুগের বাবা-মায়েরা যেমন সন্তানদের প্রতি
তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের ব্যাপারে বে-খেয়াল। তেমনি আমরা সন্তানরাও বাবা-মায়ের সাথে
আদব-আখলাক পালনের ক্ষেত্রে বে-খবর।
আসুন কোরআন ও হাদিসের আলোকে
পিতা-মাতার প্রতি আমাদের আচার-আচরণ কেমন হবে জেনে নেই:
পবিত্র কোরআনে সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ২৩ - ২৪ এ
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন,
“আর তোমার
প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন যে,
তিনি ব্যতীত অন্য কারও ‘ইবাদত না করতে এবং পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে। তাদের একজন
অথবা উভয়েই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদেরকে ‘উফ্’ বলো না এবং তাদেরকে
ধমক দিও না; আর তাদের সাথে
সম্মানসূচক কথা বলো। আর মমতাবেশে তাদের প্রতি নম্রতার পক্ষপুট অবনমিত করো এবং বলো, ‘হে আমাদের
প্রতিপালক! তাদের প্রতি দয়া কর,
যেভাবে তারা শৈশবে আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন।”
তাছাড়া পবিত্র কোরআনের সূরা লুকমান,
আয়াত:
১৪ তে আল্লাহ বলেছেন,
“আর আমরা মানুষকে
তার পিতামাতার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট বরণ করে
গর্ভে ধারণ করে, আর তার দুধ ছাড়ানো
হয় দু’বছরে। কাজেই আমার প্রতি ও তোমার পিতামাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও।
ফিরে আসা তো আমারই কাছে।”
একদা রাসুল(সাঃ)কে জনৈক ব্যাক্তি প্রশ্ন করেন, “আমার কাছে উত্তম
ব্যবহার পাওয়ার সবচেয়ে বেশি হকদার কে?"
তিনি
বললেন: "তোমার মা।" লোকটি জিজ্ঞাসা করল: "তারপর কে?" তিনি বললেন: "তারপর তোমার মা।"
লোকটি আবার জিজ্ঞাসা করল: "তারপর কে?"
তিনি
বললেন: "তারপর তোমার মা।" লোকটি আবার জিজ্ঞাসা করল: "তারপর কে?" তিনি বললেন: "তারপর তোমার পিতা।” (বুখারী, হাদিস নং- ৫৬২৬; মুসলিম, হাদিস নং- ৬৬৬৪)
আরো একটি হাদিসে রাসুল (সাঃ) বলেন,
“আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের উপর হারাম করেছেন
পিতামাতার অবাধ্য হওয়া, কন্যা সন্তানদের জীবন্ত কবর দেওয়া এবং কারও
প্রাপ্য আটক করে অন্যায়ভাবে কোন কিছু নেওয়াকে; আর তিনি
তোমাদের জন্য অপছন্দনীয় করেছেন: অনর্থক বাক্য ব্যয়, অতিরিক্ত
প্রশ্ন করা ও সম্পদ বিনষ্ট করাকে।” (বুখারী, হাদিস নং- ২২৭৭; মুসলিম, হাদিস নং- ৪৫৮০)
আরো একটি হাদিসে রাসুল (সাঃ) ইরশাদ করেন,
“আমি কি তোমাদেরকে
সবচেয়ে বড় গুনাহ সম্পর্কে সতর্ক করব না? আমরা বললাম: অবশ্যই সতর্ক করবেন, হে আল্লাহ রাসূল
সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম! তখন তিনি বললেন: আল্লাহর সাথে শরীক করা, পিতামাতার নাফরমানী করা— একথা বলার সময় তিনি
হেলান দিয়ে বসাছিলেন, এরপর (সোজা হয়ে)
বসলেন এবং বললেন: মিথ্যা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া; মিথ্যা বলা ও মিথ্যা
সাক্ষ্য দেওয়া এবং ক্রমাগত তিনি একথাগুলো বলে চললেন, এমনকি (বর্ণনাকারী আবূ
বাকরা রা. বললেন) আমি বললাম: তিনি মনে হয় থামবেন না।” (বুখারী, হাদিস নং- ৫৬৩১; মুসলিম, হাদিস নং- ২৬৯)
তিনি আরো বলেন,
“কোনো সন্তানই তার পিতার প্রতিদান আদায় করতে সক্ষম নয়; তবে সে
যদি তাকে (পিতাকে) দাস অবস্থায় পেয়ে থাকে এবং ক্রয় করার পর আযাদ করে দেয় (তবে
কিছুটা প্রতিদান আদায় হবে)।” (মুসলিম, হাদিস নং-
৩৮৭২)
আর আবদুল্লাহ ইবন মাস‘উদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:
“আমি রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলাম: আল্লাহ তা‘আলার নিকট কোন আমল
সবচেয়ে বেশি পছন্দনীয়? জবাবে তিনি বললেন:
সময় মত সালাত আদায় করা। আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম: তারপর কোনটি? তিনি বললেন: পিতা-মাতার
সাথে উত্তম ব্যবহার করা। আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম: তারপর কোনটি? তিনি বললেন: আল্লাহর
রাস্তায় জিহাদ করা।” (বুখারী,
হাদিস নং- ৫০৪ ও ৬৫২৫; মুসলিম, হাদিস নং- ২৬৪)
এক ব্যক্তি এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের
নিকট জিহাদে অংশগ্রহণের ব্যাপারে অনুমতি প্রার্থনা করল, তখন তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করে বললেন:
“তোমার পিতামাতা
জীবিত আছে কি? সে বলল: হ্যাঁ, তিনি বললেন: তুমি তাঁদের
নিকট অবস্থান কর এবং সাধ্যমত তাঁদের সেবা কর।” (বুখারী, হাদিস নং- ২৮৪২; মুসলিম, হাদিস নং- ৬৬৬৮)
আনসারদের মধ্য থেকে একজন এসে বললেন:
“হে আল্লাহর রাসূল
সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম! পিতামাতার মৃত্যুর পরও তাঁদের সাথে সদ্ব্যবহার
করার দায়িত্ব আমার উপর অবশিষ্ট থাকবে কি এবং তা আমি কিভাবে করব? তিনি বললেন: হ্যাঁ, চারটি কাজ: তাঁদের জন্য দো‘য়া করা, তাঁদের গুনাহের ক্ষমা
প্রার্থনা করা, তাঁদের করা
প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করা এবং তাঁদের বন্ধু-বান্ধবদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা; আর তাঁদের এমন সব
আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদ্ব্যবহার করা,
যাদের সাথে তোমার আত্মীয়তার সম্পর্ক শুধু তাদেরই কারণে। সুতরাং এটাই হল তোমার
উপর তাদের মৃত্যুর পরে তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করার অবশিষ্ট দায়িত্ব।” (আবূ দাউদ, হাদিস নং- ৫১৪৪; আহমাদ, হাদিস নং- ১৬১০৩)
রাসুল (সাঃ) আরো বলেন,
“কোনো ব্যক্তির পক্ষে সৎকাজগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় সৎকাজ হল
পিতার মৃত্যুর পর তাঁর বন্ধু-বান্ধবের সাথে সদ্ব্যবহার করা।” (মুসলিম, হাদিস নং-
৬৬৭৯)
পিতা-মাতার সকল আদেশ ও নিষেধ মেনে চলা
ও পিতা-মাতার আনুগত্য করা ফরজ। তবে হ্যা, তারা যদি শরিয়াহ বিরোধী কোনো কাজের আদেশ দেয় তবে তা করা যাবে না।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সূরা লুকমান, আয়াত: ১৫ তে বলেন,
“আর তোমার
পিতা-মাতা যদি তোমাকে আমার সাথে শির্ক করার জন্য পীড়াপীড়ি করে, যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান
নেই, তাহলে তুমি তাদের
কথা মানবে না এবং দুনিয়াতে তাদের সাথে বসবাস করবে সদ্ভাবে।”
আল্লাহ আমাদের প্রত্যেককে পিতা-মাতার চক্ষু শীতলকারী সন্তান হিসেবে কবুল করুন,
আমিন।
কোরআনের আয়াত ও হাদিস সমূহ যেখান থেকে নেয়া হয়েছে:
https://www.hadithbd.com/books/detail/?book=133§ion=1695