বুক রিভিউ: মুজিব বাহিনী থেকে গণবাহিনী-ইতিহাসের পূনর্পাঠ
আমরা যা খালি চোখে দেখি তার কতোটুকু সত্য তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। কারণ ঘটনার পেছনে লুকিয়ে থাকে ঘটনা, গল্পের পেছনে লুকিয়ে থাকে গল্প। যা মূলত সর্বসাধারণের চোখে না পড়লেও কিছু অনুসন্ধিৎসু মানুষ একে খুঁজে বের করে আনেন ইতিহাসের চোরাগলি থেকে। তেমনই একজন অনুসন্ধিৎসু গবেষক আলতাফ পারভেজ। এবার তিনি তার এই গ্রন্থে আলোকপাত করেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ও যুদ্ধ পরবর্তী রাজনৈতিক অবস্থার এমন একটি পর্বের এমন একটি বিষয়ের উপর যা সাধারণত খুবই সুকৌশলে এড়িয়ে যান বাংলাদেশের ইতিহাসবিদরা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ যে কেবল ১৯৭১ সালের ২৬-শে মার্চেই শুরু হয়নি আর তা যে ১৬-ই ডিসেম্বরেই শেষ হয়নি তা দেশের খুব কম মানুষেরই জানা রয়েছে। তাই মানুষকে প্রকৃত সত্যের সাথে পরিচয় করানোর দায়বদ্ধতা থেকেই বইটি লিখেছেন তিনি। এখানে তিনি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ‘কাউণ্টার রিপোর্ট’ পেশ করেছেন যেখানে একইসাথে ফুটে উঠেছে ষাট ও সত্তর দশকের বিশ্বরাজনীতি ও দক্ষিণএশিয় ভু-রাজনীতি যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরিতে ভূমিকা রেখেছিল।
তাছাড়া এ গ্রন্থটিতে পাঠক ষাটের দশকের ছাত্রলীগের মধ্যে গড়ে উঠা এক অনালোচিত
বা স্বল্প আলোচিত সংগঠন ‘নিউক্লিয়াস’ ও এর সাথে সংযুক্ত নেতাকর্মীদের কার্যক্রম, বহিঃরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার সাথে এদের
যোগাযোগ এ বিষয়গুলোর সাথে পরিচিত হবেন। তাছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের
প্রেক্ষাপট তৈরিতে এদের ভূমিকা, নিউক্লিয়াস থেকে ‘মুজিব বাহিনী’ বা ‘বাংলাদেশ লিবারেশন
ফোর্স’ (বি.এল.এফ) গঠন,
মুক্তিযুদ্ধের
সময় এর নেতাদের ‘প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার’ এর আনুগত্য অস্বীকার
ও বিরোধীতা, যুদ্ধকালীন সময়ে
মুক্তিবাহিনী ও মুজিববাহিনীর পরস্পর বিরোধী অবস্থান ও ক্ষেত্রবিশেষে সংঘর্ষ, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে মুজিব বাহিনীর মধ্যে ‘মুজিববাদ’ ও ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের’ আদর্শের ভিত্তিতে
ফাটল, মুজিব বাহিনী বা
ছাত্রলীগের সমাজতন্ত্রপন্থিদের নিয়ে ‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল’ নামের নতুন দল গঠন, স্বাধীনতা পরবর্তী রাজনীতিতে উক্তদলের ভূমিকা, জাসদের সামরিক শাখা ‘বিপ্লবী গণবাহিনী’ গঠন, রক্ষীবাহিনী কর্তৃক কিছু নির্যাতনের ঘটনা ও
ভুক্তভোগীদের জবানবন্দি, তৎকালীন রাজনৈতিক
অবস্থার সাথে বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তা, তৎকালীন বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক ও কমিউনিস্ট
দলগুলোর মধ্যে বিভেদ ও সংঘর্ষ ইত্যাদি ফুটে উঠেছে।
মোটকথা, বইটি সদ্য স্বাধীনতপ্রাপ্ত
বাংলাদেশ নামক রাষ্টটির প্রথম পাঁচ বছরে চলা ত্রি-মুখী গৃহযুদ্ধের এক রক্তাক্ত
ঐতিহাসিক উপাখ্যান।